ব্রহ্মপুত্র নদের কড়াল গ্রাসে ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব আমজাদ আলী (৬৫) এক দৃষ্টিতে পানির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। চোখ গড়িয়ে পড়ছে পানি, উদাস মন। ডাক দিতেই হকচকিয়ে উঠেন তিনি।

নদীর পানিতে কী খোঁজেন বলতেই, হাউ মাউ করে কেঁদে উঠেন তিনি। একটু শান্ত হয়ে বলেন, “মোর সব শ্যাষ বাবা, ভিটেমাটির কোনো চিহ্ন নাই। নিজের বলে আর কিছুই নাই। এ্যালা কোটে যামো, কোটে থাকমো। কাইল সারা রাইতে ঘুমাই নাই। একটার পর একটা বাড়ি খায়া নেইল রাক্ষুসী নদী। চোখের পলকে সব শ্যাষ।”

আমজাদ আলী কুড়িগ্রামে উলিপুর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের মধ্যে সাহেবের আলগা ইউনিয়নের হকের চর গ্রামের বাসিন্দা। একই গল্প এখানকার শত পরিবারের।

তিনি বলেন, “ঘর সরে নেওয়ার সময় শিলছে না। মোর বাড়ি গেইল পইল সন্ধ্যাত। এরপর সারা রাইতে একের পর এক বাড়ি ভাঙ্গি গেইল শামসুল হক, মোখছেদ আলী, বেলাল, ফাতেমা, মানিক ও মঞ্জু মিয়ার বাড়িঘর সোগ। রাইতজাগি টানাটানি করি যতটুক বাঁচানো যায় কাপড়-চোপর জিনিসপত্র। ভিটেমাটি না থাকলে নিজের বলে আর কিছুই থাকে না। এ্যালা হামার কোনো ঠিকানা নাই।”

সাহেবের আলগা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোজ্জাফর হোসেন বলেন, চলতি বন্যায় তার ইউনিয়নে ১৯৭ পরিবার নদী ভাঙনের শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়েছে। এর মধ্যে হকের চরে ৯০ পরিবার, দক্ষিণ নামাজের চরে ৪৭ পরিবার ও দৈ খাওয়ার চরে ৬০ পরিবার ভাঙনের শিকার হয়।

তিনি বলেন, এই ইউনিয়নে সাড়ে ছয় হাজার ৫০০ পরিবারের মধ্যে ৫০০ পরিবার স্বচ্ছল। বাকি সবাই কম-বেশি গরিব। প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ এখনও পানিবন্দি। এখন পর্যন্ত ত্রাণ হিসেবে ২ টন চাল আর ১০০ প্যাকেট শুকনা খাবার পেয়েছি।

চেয়ারম্যান মোজ্জাফর বলেন, এর মধ্যে বিভাগীয় কমিশনার এসে বিতরণ করেছেন ২৯০ কেজি চাল আর উপজেলা পরিষদ থেকে ১৫০ প্যাকেট শুকনা খাবার। ফলে অনেকের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।”

হকের চরের আমজাদ আলীর তিন সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে হাঁটছেন।

আপাতত আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় নিবেন। এই হকের চরের মানুষ বন্যায় একদিন শুকনা খাবার ছাড়া আর কোনো ত্রাণ তাদের ভাগ্যে জোটেনি।

একই এলাকার হাজরা বেগম বলেন, “হকের চরের গুচ্ছগ্রামে সরকারি ঘরে আছলং। নদী ভাঙনে সে ঘর গেইল। তোমরা একনা নেকিদেন বাহে হামাক জানি সরকার ফির ঘর দেয়। নাইলে থাকমো কোনটে।”

ওই চরের কৃষিশ্রমিক শাহাবুল এবং তার স্ত্রী রোকেয়া দুজনে মিলে ভাঙা ঘরের জিনিসিপত্র নিয়ে নৌকায় উঠছেন।

রোকেয়া বলেন, গুজিমারীর চরে বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিতে যাচ্ছেন। ছেলে রুহুল আমিন এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন উলিপুরে একটি ছাত্রাবাসে থেকে। আর মেয়ে শারমিন অষ্টম শ্রেনির ছাত্রী। তার পড়াশোনা বন্ধের উপক্রম। কারণ স্কুল অনেক দূরে; যাতায়াতে সমস্যা।