
জিন্নাত আরা নূর : সমাজ বা দেশ গঠনে নারী-পুরুষ উভয়ের সমান দায়িত্ব রয়েছে। কবি নজরুল তার নারী কবিতায় লেখেন- ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ কবিতার পঙ্ক্তিতে পরিষ্কার বোঝা যায় মানবকল্যাণে নারীর ভূমিকা কতটা জরুরি ও তাৎপর্যবহ।কোনো জাতিকে বিদ্বান হতে হলে সে জাতির নারীদেরও বিদ্বান হতে হবে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এখনো পুরুষের জন্য বিদ্যাচর্চার অনুকূল পরিস্থিতি ও দৃষ্টিভঙ্গি যতটুকু আছে নারীদের জন্য ততটুকু নেই। আমেরিকার সংযুক্ত রাষ্ট্রগুলো, গ্রেট ব্রিটেন ও উত্তর আয়ারল্যান্ড, জাপান, জার্মান, কানাডা প্রভৃতি দেশের নারীরা সবক্ষেত্রে খুবই বিচক্ষণ।
বর্তমানে নারীরা বাংলাদেশের মোট লোকসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। জাতিকে সামনের দিকে যেতে হলে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও বিদ্বান করে গড়ে তুলতে হবে। নারীরা এখন সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান ব্যক্তি এবং মন্ত্রিসভার সভাপতির দায়িত্বসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছে।
আমাদের দেশে এ সময়ে শিক্ষিত মায়ের খুবই প্রয়োজন। একজন শিক্ষিত মা-ই তৈরি করতে পারেন একজন শিক্ষিত সন্তান। মহাবীর নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, ‘আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।এ সময়ের নারীরা শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, পুলিশ অফিসারসহ অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছে।
দূর অতীতেও দেশগঠনে নারীদের ভূমিকা ছিল, বর্তমানেও তা আছে। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যতগুলো আন্দোলন হয়েছে প্রতিটি আন্দোলনে নারীদের বিশেষ অবদান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, আয়ারল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে প্রভৃতি দেশের নারীরা সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, শান্তি, আন্তর্জাতিক রাজনীতিসহ নানাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বেনজির ভুট্টো, ইন্দিরা গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী, শ্রীমাভো বন্দরনায়েক, মাদার তেরেসা, মার্গারেট থ্যাচার, হিলারি ক্লিনটন, কন্ডোলিৎসা রাইস প্রমুখ বিদ্যাচর্চা ও ধী-শক্তির কারণে নারী হয়েও পৃথিবীব্যাপী পরিচিত। এছাড়া আমাদের দেশের নারীরাও নানাক্ষেত্রে তাদের কর্মদক্ষতা দেখিয়েছেন। যেমন সুফিয়া কামাল, বেগম রোকেয়া, জাহানারা ইমাম, সেলিনা হোসেন প্রমুখ। অন্যদিকে রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাফল্যের চূড়ায় অবস্থান করছেন।
বর্তমানে দেশে নারীশিক্ষার মূল প্রতিবন্ধকতাই হচ্ছে কুসংস্কার। আরেকটি বড় বাধা হচ্ছে নিরাপত্তার অভাব।আমাদের দেশে নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য কিছুসংখ্যক কাজের তালিকা বা নির্ঘণ্ট গ্রহণ করা আবশ্যক। যেমন- দেশে নারীশিক্ষা গ্রহণকারীর অনুপাতে দরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, নারীদের সামাজিক নিরাপদ অবস্থা নিশ্চিতকরণ, বয়স্ক-অক্ষরজ্ঞানহীন নারীদের শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য সামাজিক সচেতনতা তৈরি, বাংলাদেশ সরকার নারীশিক্ষা প্রসারে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ছাত্রীদের জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছে। অন্যদিকে বয়স্ক নারীদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য ‘বয়স্ক নারীশিক্ষা কেন্দ্র’ চালু করেছে।
নারীশিক্ষার অগ্রগতির জন্য প্রথমেই যা করতে হবে তা হলো, পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে নারী-পুরুষ উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। কবি নজরুলের সেই অমর পঙক্তিমালা ‘কোন কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি/প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়া-লক্ষ্ণী নারী।’
অতএব, নারীকে পেছনে রেখে উন্নতির আশা করা দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়। একমাত্র বিদ্যাচর্চাই দেখাতে পারে নারীদের মুক্তির সুনিয়ন্ত্রিত উপায়।