নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি : মোঃ তানসেন আবেদীন

সেলিনা হায়াৎ আইভী। ‘সততা, কর্মনিষ্ঠা ও নির্ভীকতার’ কারণে দেশ ও দেশের বাইরে ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সদ্য সাবেক এই মেয়রের। নারায়ণগঞ্জ শহরের মানুষও তাকে আস্থার জায়গায় স্থান দিয়ে বারবার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করেছেন। শুরুতে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা এবং পরবর্তীতে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে চেয়ারে ছিলেন টানা ২১ বছর। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও দলমত নির্বিশেষে সকলের ‘মেয়র আইভী’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

তবে, দীর্ঘ এই পথচলা সহজ ছিল না তাঁর। কখনও দুর্নীতি দমন কমিশনে মিথ্যা অভিযোগ করে, আবার কখনও ব্যঙ্গচিত্র তৈরি, দেবোত্তর সম্পত্তি দখলের অভিযোগ, মসজিদ-মন্দির ইস্যুতে উত্তেজনা তৈরিসহ নানা চেষ্টা করে তাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করে তাঁর দলের একটি অংশ। আইভীবিরোধী এই অংশটি হত্যা, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, ভূমিদস্যুতায় লিপ্ত ছিলেন। এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ‘সাহসী কণ্ঠস্বর’ আইভী এসব কারণেই হয়ে ওঠেন তাদের চক্ষুশূল। তবে কোনো ষড়যন্ত্র করেও আইভীকে সেই সময় ঘায়েল করা যায়নি।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আইভীবিরোধী অংশটি শহরছাড়া হলেও তাদের ষড়যন্ত্র এখনও থামেনি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা আইভীবিরোধী ওই অংশটি গত সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের আগে ২০২১ সালে হাফিজুর রাহমান নামের ‘কল্পিত এক ব্যক্তিকে’ দিয়ে আইভীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দায়ের করে।

অভিযোগ রয়েছে, এই অভিযোগের পেছনে ছিলেন তাঁর দলেরই কয়েকজন ব্যক্তি। ‘কল্পিত ব্যক্তির’ ওই দুর্নীতির অভিযোগটি নিয়ে দুদক তদন্তে নেমেছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রচারিত হয়েছে।

সেলিনা হায়াৎ আইভী দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধানকে স্বাগত জানালেও বিষয়টি ভালভাবে দেখছেন না তাঁর শুভাকাঙ্খী ও নগরবাসী। তাদের ভাষ্য, রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত করতে আইভীবিরোধী ওই অংশটি এবার ওই মিথ্যা অভিযোগটি ব্যবহারের চেষ্টা করছেন। তবে, দুদক সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করলেও এই অভিযোগ যে মিথ্যা তার প্রমাণ পাবেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সেলিনা হায়াৎ আইভী। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হতে থাকে আওয়ামী লীগের হাল ধরছেন আইভী। তাকে করা হবে দলটির সাধারণ সম্পাদক। এমন প্রচারকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মুখে ফেলারও একধরনের পায়তারা বলে মনে করেন আইভীর শুভাকাঙ্খীরা।

এর আগে গত ৩ সেপ্টেম্বর ‘পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ’ হিসেবে পরিচিত সেলিনা হায়াৎ আইভীকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন গুলিতে নিহত পোশাক শ্রমিক মিনারুল হত্যা মামলায়ও আসামি করা হয়েছে। যেই মামলার আসামি শামীম ওসমানও। মামলার এজাহারে উল্লেখ রয়েছে, শামীম ওসমানের নেতৃত্বে তার সন্ত্রাসী বাহিনী ওইদিন ছাত্র-জনতার উপর গুলি ছুড়েছে এবং শামীম ওসমানের ছোড়া গুলিতে মারা গেছেন মিনারুল।
অথচ একই দলের হলেও শামীম ওসমানের সাথে মতবিরোধ সম্পর্কে সারা বাংলাদেশের মানুষ জানেন। এমনকি শামীম ওসমানের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে প্রকাশ্যে তাকে ‘গডফাদার’ বলতেও যে মানুষটি দ্বিধাবোধ করেননি, তাকেই করা হয়েছে শামীম ওসমানের গুলিতে নিহত পোশাক শ্রমিক হত্যা মামলার আসামি।

আইভীর সমর্থকরা বলছেন, আর্থিকভাবে বেশ সামর্থ্যবান ছিল আইভীর পরিবার। তাঁর পিতা প্রয়াত পৌরপিতা আলী আহাম্মদ চুনকা জীবদ্দশায় নিজের সম্পদ বিক্রি করে সাধারণ মানুষের উন্নয়নে কাজ করেছেন। আওয়ামী লীগের দুর্দিনে নেতা-কর্মীদের কাছে ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। ‘চুনকা পরিবার’ এর সদস্য আইভীও তার পিতা আলী আহাম্মদ চুনকার দেখানো পথেই হেঁটেছেন। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমি দান করেছেন মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণের জন্য। অর্থ ব্যয় করেছেন সাধারণ মানুষের কল্যাণে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে নামের পাশে কখনও দুর্নীতি বা অনিয়মের কালিমার কোনো ছাপ লাগতে দেননি। সৎ রাজনীতিবিদদের মধ্যে একজন আইকন হিসেবে নিজেকে মানুষের সামনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সেই আইভীর বিরুদ্ধে দুদকে এইসব অভিযোগকে ষড়যন্ত্র বলছেন তারা।

আইভীর পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, দেওভোগে ‘চুনকা কুটির’ নামে একটি বাড়ি রয়েছে আইভীর। এই বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছে পৈত্রিক ভিটাতে। এই বাড়ি নির্মাণ খরচ বহন করতে মেয়র আইভীর পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া দু’টি জমি বিক্রি ও একটি জমি বায়না করতে হয়েছে। পারিবারিকভাবে নির্মিত এই জমির মালিকানাও মেয়র আইভীর নয়। তার ভাই ও পরিবারের অন্য সদস্যরা এই বাড়ির মালিকানায় রয়েছেন। চুনকা কুটির নির্মাণে ব্যয় সাড়ে ৫ কোটি টাকা হলেও এটি নির্মাণে ২০ কোটি বা তারও বেশি খরচ হয়েছে বলে এক ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে বলে দাবি পরিবারের লোকজনের।

এদিকে, দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানকে স্বাগত জানালেও অভিযোগ ‘সুপরিকল্পিত’ বলে দাবি করেছেন আইভী। এই কাজ এর আগেও করা হয়েছে বলে জানান আইভী।

তিনি বলেন, ‘এটি সুপরিকল্পিতভাবেই করা হচ্ছে। আমার ভাইয়েরা অনেকটা নিরীহভাবেই থাকে। আমার পরিচয়ে আমার ভাইদের বড় হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ আমার বাবা এই শহরের স্বনামধন্য একজন ব্যক্তি ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান তিনি। আমার ভাইদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে কোনো লাভ হবে না, কারণ তারা কোনো কিছুর সাথে জড়িত না এবং আমিও না। আমি সিটি কর্পোরেশনের মেয়র থাকাকালীন সময়ে আমি আমার পরিবারের কোনো সদস্যকে অনৈতিক কোনো সুবিধা নিতে দেইনি। কারণ, আমার বাবা আমাকে সততার পাঠ পড়িয়েছেন, তাঁর দেখানো পথেই আমি সবসময় চলেছি। মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছি।