কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে বন্যার পানি কিছুটা কমতে শুরু করছে। এতে ভেমে উঠছে বন্যার ক্ষতি। তা দেখে বানভাসীদের কান্না বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গোমতী নদীর ভাঙনকবলিত এলাকাগুলোয় ভয়াবহ ক্ষতির চিহ্ন দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ছে সেখানকার মানুষ। সব হারিয়ে নিঃস্ব মানুষগুলোর সামনে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।

গোমতীর ভাঙনের ফলে বুড়িচং উপজেলার বেড়িবাঁধ সংলগ্ন অন্তত ৬টি গ্রামের মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেকের বাড়িঘর ভেঙে পড়েছে। দীর্ঘদিন পানির নিচে থাকার পর ঘরের মালামাল নষ্ট হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষকে পুনর্বাসনের পাশাপাশি তাদের মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখতেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সোমবার বুড়িচং উপজেলায় গোমতীর ভাঙনকবলিত বুড়বুড়িয়া, বেড়াজাল, মহিষমারা, ইন্দ্রাবতি, খাড়াতাইয়া, নানুয়ার বাজারসহ আশপাশের এলাকাগুলো ঘুরে দেখা গেছে বন্যায় ভয়ানক ক্ষতির চিত্র। এসব এলাকার বেশির ভাগ সড়কই ভেঙে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অনেকের বাড়িঘর ভেঙে গেছে। রাস্তার পাশে বড় বড় গাছ শেকড় উপড়ে পড়ে আছে। যেসকল মানুষের ঘরগুলো ঢিকে আছে; সেগুলোও যায় যায় অবস্থা। বেশির ভাগ ঘরই কাত হয়ে আছে। ঘরের ভেতর থাকা সকল আসবাবপত্র নষ্ট গেছে। ঘরে পলি মাটির স্তুপ পড়ে আছে। এসব দেখে হাহাকার করে উঠছেন সেই এলাকার মানুষ।

বেড়াজাল গ্রামের রশিদ পুলিশের বাড়ি সংলগ্ন দরিদ্র বিলকিস বেগমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বানের তোড়ে তার ঘরটি ভেঙে পড়েছে। ঘরের ভেতরের আসবাবপত্র সব নষ্ট হয়ে গেছে। বন্যার এই ক্ষতচিহ্ন দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে তিনি বলতে থাকেন, ‘এই বন্যায় আমার সব শেষ হয়ে গেল, সব গেল। এই পানি আমার সব কাইরা নিল। আমি ঘর পামু কই, থাকমু কই। হায় আল্লাহ, কী সর্বনাশ হইল আমার।’ বলেই আবারো বুক চাপড়াতে থাকেন তিনি।

একই চিত্র দেখা গেল পার্শ্ববর্তী ইন্দ্রাবতী গ্রামের ধীরেন্দ্র চন্দ্র দাসের বাড়িতে গিয়ে। বন্যার পানিতে ধীরেন দাসের ঘরটি মাটিতে মিশে গেছে। ছেলের বউ আর দুই নাতিকে নিয়ে ভাঙা ঘরের ভিটির ওপর দাঁড়িয়ে নতুন ঘর তৈরি নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেলেন তিনি।

ধীরেন দাস বলেন, ‘আমি বেকার, কিছুই করি না। আমার ছেলে বিশ্বজিত বিদেশে থাকে। তার পাঠানো সব টাকা দিয়ে ঘরটা বানাইছিলাম। বন্যায় সব শেষ হয়ে গেল। এখন কীভাবে নতুন ঘর করব? তাদের নিয়ে কোথায় থাকব। আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।’

শুধু বিলকিস বেগম কিংবা ধীরেন দাসই নন- গোমতীর ভাঙনের ফলে বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার অসংখ্য মানুষ এমন ঘরহারা হয়ে পড়েছে। যাদের ঘর টিকে আছে, সেসবে সব মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি হারানো মানুষজন এখন শেষ সম্বর খালি ভিটির ওপর হাতরে বেড়াচ্ছেন ঘরের শেষ স্মৃতিচিহ্ন।

বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাহিদা আক্তার বলেন, ‘গোমতী নদীর ভাঙনের সম্মুখে থাকা বুড়িচংয়ের ৬টি গ্রাম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব গ্রামের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। পুনর্বাসন করতে হবে দ্রুত। যেহেতু এই এলাকার মানুষের একসময় সবই ছিল- এখন তারা অনেকেই নিঃস্ব। তাই তাদের মনোবলও ভেঙে পড়েছে। অনেকেই আগ্রাসি আচরণও করছে। পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্ব দিয়ে মানসিকভাবেও প্রশান্তি দিতে হবে। বিষয়টি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা মহোদয়ের কাছে জানানো হয়েছে। বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনের বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

জানা গেছে, চলমান বন্যায় কুমিল্লার ১৪ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার ৫ লক্ষাধিক মানুষ। বুড়িচং অংশে গোমতী নদীর ভাঙন, ব্রাহ্মণপাড়া অংশে সালদা নদীর ভাঙ্গন এবং সদর উপজেলা অংশে ঘুংঘুর নদীর ভাঙনের ফলে বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়ার মানুষজন পানিবন্দী হয়ে পড়ে। দীর্ঘ ১৫দিন পর পানি কিছুটা কমতে থাকলেও এখনো অনেকে পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। ঘরবাড়ি ভেঙে, মালামাল নষ্ট হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এ দুই উপজেলার মানুষ।