আব্দুর রহমান, কুমিল্লা : বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে স্বৈরাচারী সরকার পতনের গল্প ছড়িয়ে দিতে সারা দেশে দেয়ালে দেয়ালে আঁকা হচ্ছে গ্রাফিতি। আন্দোলনে শহিদদের স্মরণ এবং ঘটনা প্রবাহ স্মরণীয় করে রাখতে বিভিন্ন স্কুলকলেজের শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছায় করছেন এই কাজ। তাঁদের সহযোগিতা করছেন সমমনা সাধারণ মানুষ। প্রবীণরা রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনেরা মনে করেন, গ্রাফিতিতে আঁকা চেতনা বাস্তব জীবনে ধারণ করলে বদলে যাবে সমাজ। তরুণ প্রজন্ম দেয়ালের এই রঙকে ভালোবাসতে পারলেই বদলে যাবে এই বাংলাদেশ।

কুমিল্লা শহর ঘুরে দেখা গেছে, কুমিল্লা জিলা স্কুলের ক্যাম্পাসে গ্রাফিতি ও ক্যালিওগ্রাফি মিলে মোট ৩২টি পৃথক ফ্রেমে দেয়াল অঙ্কন করছে শিক্ষার্থীরা।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শহিদ স্মরণ, বিপ্লবী পদক্ষেপ এবং সাহসী ঘটনার প্রবাহ তুলে ধরা হচ্ছে এসব গ্রাফিতিতে। সারা শহরেই স্কুলকলেজের শিক্ষার্থীরা দলে দলে ভাগ হয়ে গ্রাফিতিতে রাঙিয়ে তুলছে নতুন বাংলাদেশর গল্প, আন্দোলন অভ্যুত্থানের গল্প। কুমিল্লা নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, কুমিল্লা মডার্ন স্কুল, ইসলামিয়া আলিয়া মাদ্রাসাসহ শহর ও উপজেলা পর্যায়ে স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা আঁকছেন আন্দোলন সংগ্রামের উল্লেখযোগ্য ঘটনা, সাহসী শিক্ষার্থীদের প্রতীকিচিত্র, স্মরণের স্মৃতিস্মারক এবং স্লোগান।

এ ছাড়াও স্বৈরাচার সরকারের নানান অপকর্মের প্রতিবাদে এসব গ্রাফিতিতে উঠে আসছে ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন ও ডায়ালগ। আবু সাইদ-মুগ্ধের আত্মত্যাগ, নূর হাসানের ত্যাজোদ্দীপ্ত দৃষ্টি, ছাত্র-জনতার শেকল ভাঙার গান কিংবা পুলিশের সামনে ছোট্ট শিশুর প্রতিবাদ, স্বৈরাচার প্রতিহত করার স্লোগান দেয়ালে ফুটে উঠছে।

কুমিল্লা জিলা স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী রোটারিয়ান সাইদুর রহমান তাইফ জানান, কুমিল্লা জিলা স্কুল এই শহরে আন্দোলন সংগ্রামের নিউক্লিয়াস। শহরে আন্দোলনের সূত্রপাত এই ক্যাম্পাস থেকেই। এই স্কুলের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্ররাই বিভিন্ন জায়গায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে সাহসিকতা দেখিয়েছে। কুমিল্লায় আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন নবাব ফয়জুন্নেসা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মেয়েরাও। শিক্ষার্থীরা একাত্ম হয়ে কুমিল্লা জিলা স্কুলের দেয়ালে যেমন ৩২টি গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে, তেমনি ফয়জুন্নেছা স্কুলের দেয়াল আঁকা হয়েছে বৈষম্যবিরোধী নানান দেয়াল চিত্র।

নবাব ফয়জুন্নেসা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মিফতাহুল জান্নাত মারিয়া বলেন, ‘আন্দোলনে আমরা প্রথমে কয়েকজন ছিলাম। পরে আমাদের সাথে ছোট বড় আরো অনেকেই যোগ দিয়েছে। যারা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে পারেনি তাদের সামনে পটভূমি ধরতেই এই গ্রাফিতি অঙ্কন। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সাহস ও ত্যাগের গল্প তুলে ধরা হচ্ছে এসব দেয়ালে।’

শিক্ষার্থীরা জানালেন, শুধু শখের বশেই এসব আঁকাআঁকি নয়- বরং সরকার পতনের আন্দোলনের যে ত্যাগ তিতিক্ষা তা সাধারণ মানুষের মাঝে স্মরণীয় রাখতেই উদ্যোগ। শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতি বা দেয়াল চিত্র থেকে সাধারণ মানুষ যেন ন্যায় ও স্বাধীনতার বার্তা পায় এ বিষয়টি সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে বলেও জানান তাঁরা।

শিক্ষার্থীরা জানান, দেয়ালে আঁকতে দলমত নির্বিশেষে সবাই সহযোগিতা করছেন। ঘটনা প্রবাহ ও ইতিহাস ধরে রাখতে এসব গ্রাফিতি সংরক্ষণ করাও সবার দায়িত্ব।

বিশিষ্টজনেরা জানান, গ্রাফিতি আঁকার চেতনা বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারলে তা দিন বদলের মন্ত্র হিসেবে কাজ করবে। তাই নতুন প্রজন্মকে পরিবর্তনের চেতনা ধারণ করতে হবে।

কুমিল্লার প্রবীণ সাংবাদিক মাসুক আলতাফ চৌধুরী বলেন, গ্রাফিতিতে ব্যবহার হওয়ার রং শুধু রং নয়- এগুলোও ভাষা। রং দিয়ে বুঝানো হয়েছে, আঁকা হয়েছে- দমন, নিপীড়ন, কষ্ট, বাকস্বাধীনতা, বুলেটের ক্ষত, প্রতিবাদ। এই ছাত্র আন্দোলনকে সফলতার কাছে আনতে যত ঘটনা সেগুলোই শিক্ষার্থীরা আঁকছেন। এসবই বার্তা বহন করে। যারাই গ্রাফিতি বা দেয়াল অঙ্কন করছেন তারা যেন সঠিক বার্তা দিতে পারেন।