
শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার পর বেশ আলোচিত হচ্ছে আয়নাঘর। গুম এবং নিখোঁজদের খুজে পাওয়া যাচ্ছে এ আয়নাঘরে। গুম হওয়া এসব মানুষের খোঁজে স্বজনরাভিড় জমাচ্ছেন কচুক্ষেত এলাকায়। বিভিন্ন গণমাধ্যম এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গুম হওয়া প্রায় দুইশতাধিক মানুষ মুক্তি পেয়েছে এই আয়নাঘর থেকে।
আয়নাঘর কি?
আয়নাঘর এক কথায় বললে গোয়েন্দা সংস্থার গোপন বন্দিশালা। যা প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাউন্টার টেররিজম ইন্টেলিজেন্স বু্্যারো (সিটিআইবি) দ্বারা পরিচালিত। সুইডেন ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল নেত্র নিউজের অনুসন্ধানী সুত্রে জানা যায়, আয়নাঘরের অবস্থান ঢাকা সেনানিবাস এলাকায়। রয়েছে আলোবাতাসহীন গুমোট মোট ১৬ টি কক্ষ। যেখানে বন্দি করে রাখা হত আওয়ামী বিরোধী লোকদের।
হাসিনা আমলেই আয়নাঘরের জন্ম। তার শাসনামলে ২০০৯-২০২১ পর্যন্ত মোট ৬০৫ জনকে গোপনে বন্দি করা হয়েছে বলে বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়। তবে আয়নাঘর জনসম্মুখে প্রথমবার আসে ২০২২ সালে নেত্র নিউজের এক ভিডিও প্রতিবেদনে। সে প্রতিবেদনে গুম হওয়া দুজন ব্যক্তির লোমহর্ষক বর্ণনার মাধ্যমে উঠে আসে আয়নাঘরের চিত্র। একজন সেলিম অপরজন হলেন প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা হাসিনুর রহমান। হাসিনুর জানান,উত্তরে ১৪ তলা বিল্ডিং, দক্ষিণে মেস বি। উত্তর-পুর্বে ডিজিআইয়ের মসজিদ। মাঝখানে মাঠ আর এ মাঠেই সেই গুমঘর। যা তিনি শৌচাগারের এগজস্ট ফ্যানের ফাঁকা জায়গা দিয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন। দুজনের বর্ণনা মতে কক্ষের দরজা লোহার শিকের, তারপর কাঠের দরজা যেখানে একটি ছিদ্র করা। সেলিমের দেওয়া বিবরণে জানা যায়, প্রত্যেক ঘরে এগজস্ট ফ্যান রয়েছে। ফ্যানগুলো বন্ধ হলে শোনা যেত আর্তনাদ। তিনি আরও জানান, যে ঘরে বন্দি ছিলাম সেখানে অনেক লেখা ছিল। অনেকে তার পরিবারের ফোন নম্বর লিখে যোগাযোগ করার অনুরোধ করছেন।
এক বন্দি আরেক বন্দিকে যেন চিনতে না পারে সেজন্য মুখে কাপড় বেধে নিয়ে যাওয়া হত শৌচাগারে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ছিল আলাদাকক্ষ যার নাম টর্চার সেল। সেলিম জানান, তাকে একবার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেই কক্ষে। তদন্তকারীদের প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারায় জুটেছিল বেদম মার। পরে তদন্তকারীরা বুঝতে পেরেছিল যে একই নামের কারণে ভুলবশত তারা অন্যকাউকে নিয়ে এসেছিল। যেজন্য সেলিম পরবর্তীতে মুক্তি পায় সে বিভীষকাময় বন্দিশালা থেকে।
আয়নাঘরে থাকাকালীন তার আশেপাশের কয়েদিদের সাথেও কথা হয়েছিল তার। দিনে ৩০ মিনিটের জন্য এগজস্ট ফ্যান বন্ধ হলে সেসময়ে তারা একে অন্যের সাথে কথা বলতেন। এক কয়েদি তাকে বলেছিলেন সব টয়লেটে তিনি তার বাড়ির নাম্বার লিখে রেখেছেন। ফিরে গিয়ে তিনি যেন তার বাড়ির লোকেদের সাথে য়োগাযোগ করে। সেলিম মুক্তি পেয়ে সরাসরি মালয়েশিয়া চলে যান। সেখান থেকে সে লোকের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করলে পরিবার থেকে সেলিমকে ফোন করতে মানা করেন। কারণ সরকার তাদের সব গতিবিধিতে নজর রাখছেন।
সামরিক বাহিনীর একটি সূত্র কারাগারের সাবেক ও বর্তমান বন্দিদের একটি তালিকা নেত্র নিউজকে দিয়েছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন মোবাশ্বের হাসান, যিনি ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি নিখোঁজ হওয়ার পর ভারতের সংবাদ মাধ্যম দ্য ওয়্যারের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, তাকে ডিজিএফআই অপহরণ করেছে। সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, যিনি নিজেও একজন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, ও ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায় একসময় আয়নাঘরে বন্দি ছিলেন।
সম্প্রতি আয়না ঘর থেকে মুক্তি পেয়ে সাবেক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আযমী (হাফি.)বলেন, আমি কতদিন আলো-বাতাস দেখি না, আল্লাহর দুনিয়া দেখি না, ওরা আমাকে আযান শুনতে দেয় নাই। আমার এই গামছাটা তে আমি যেই পরিমাণ চোখের পানি মুছেছি, ওই পানি জমাইলে একটা দিঘি বানানো যেতো।
উল্লেখ্য আয়নাঘরে যাদের আনা হয় খাতা কলমে তাদের কোন অস্তিত্ব থাকে না। এমনকি যারা অত্যাচার সহ্য করতে না মেরে মারা যায় তাদের লাশ সরিয়ে ফেলা হয়।